ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস পাড়ের স্বনামধন্য কবি, গবেষক ও লেখক তিতাশ চৌধুরী বিগত ১ ডিসেম্বর ঢাকায় নিজ বাসায় ইন্তিকাল করেন। তিনি ১৯৪৫ সালের ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সিন্দুরউরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একাধারে কবি, লেখক, সম্পাদক, গবেষক ও অনুবাদক হিসেবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ১৯৬৬ এবং স্নাতকোত্তর (১৯৬৭) ডিগ্রি অর্জন করে তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনার পর সর্বশেষে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে কয়েক বছর নানা রোগে আক্রান্ত থাকলেও পরিণত বয়সে জীবনের শেষাবধি তিনি সাহিত্য চর্চায় পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িক পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি ছাড়াও তাঁর অনেক গ্রন্থ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। তবে এখনো তাঁর বহু সংখ্যক গ্রন্থ অপ্রকাশিত রয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থাবলি গদ্য ও পদ্যরীতিতে এবং এর বিষয়াবলি বিচিত্র ধরনের। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা থেকে এর পরিচয় সুস্পষ্ট হবে :
কবিতা : ১. দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী (১৯৭৮), ২. তুমি সুখেই আছো নন্দিনী (১৯৯৩), ৩. তোমাদের জন্য ভালোবাসা (২০০৪)।
গবেষণা ও সাহিত্যালোচনা : ১. নিষিদ্ধ নজরুল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৯০) ২. জসীমউদ্দীন : কবিতা, গদ্য ও স্মৃতি (১৯৯৩), ৩. মোতাহের হোসেন চৌধুরী : জীবন ও সাহিত্য (২০১১), ৪. কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি প্রেম ও পরিণয় (২০০৯), ৫. নজরুলের নানাদিক (২০০১), ৬. অন্য বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ (২০০২), ৮. অন্যরকম রবীন্দ্রনাথ (২০০৪), ৯. কুমিল্লার সংবাদপত্র ও সাময়িকী (২০০৩), ১০. ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক মেজর আব্দুল গণি : জীবন ও কর্ম ভুবন (২০০৯), ১৩. আমাদের মক্তিসংগ্রামে নজরুল সঙ্গীতের ভূমিকা (২০১১), ১৪. উনিশ শতকের সাময়িকপত্র উষায় জীবন ও সমাজ (২০০৯)।
ফোকলোর : ১. কুমিল্লা জেলার লোকসাহিত্য (১৯৯৩), ২. দরবেশ ও দরগার কথা (১৯৯৮), ৩. বৈশাখ ও আমাদের ঐতিহ্য চেতনা (২০০০), ৪. লোকসাহিত্যের নানাদিক (২০০৯)।
শিশুতোষ : ১. ষাটগুম্বুজের আযান ধ্বনি (২০১১), ২. রসহস্যময় বাড়ি (১৯৯০), ৪. শেকড়ের সন্ধানে (২০০৯), ৫. বিন্নি ধানের খই (২০১১), ৬. তা ধিন ধিন (২০০৯)।
অনুবাদ : ১. ত্রিবেণী (১৯৮৫), ২. অন্যস্বর (২০০৪),
স্মৃতিকথা : দেখা অদেখার স্মৃতি (২০১১)।
ইতিহাসমূলক : কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস (২০০৮)।
সম্পাদনা : ১. আবদার রশীদের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯), ২. কুমিল্লা জেলার ইতিহাস (যৌথ) (১৯৮৪), ৩. রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ, ৪. দ্যা ব্লুম (যৌথ, মাদ্রাজ) (১৯৯৫), ৫. একজন কে জি মোস্তফা (২০০৭), ৬. লেখকের পত্রাবলি : সমায়িকপত্র সম্পাদনা : অলক্ত ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
সম্মাননা ও পরস্কার : দুই বাংলার পত্রিকা প্রতিযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলা থেকে ‘অলক্ত’ পত্রিকা সম্পাদনার জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ (১৯৭৮), কুমিল্লা জেলার ইতিহাস রচনা ও সম্পাদনার জন্য স্বর্ণপদক (১৯৮৪) এবং বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক ১৯৯৬ লাভ করেন।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিতাস চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তবে বর্তমান নিবন্ধে শুধুমাত্র কবি হিসেবে তিতাসের পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস পাব।
কবিতা ব্যক্তিগত অনুভূতির অন্তরঙ্গ প্রকাশ। প্রেম ও প্রকৃতিকে আশ্রয় করে তিতাশ চৌধুরী তাঁর অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রত্যেক কবির কবিতায়ই প্রেম ও প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে। তিতাশ চৌধুরী এক্ষেত্রে হয়তো কোনো ব্যতিক্রম নন, তবে তাঁর শব্দচয়ন, প্রকাশ ভঙ্গি, উপমা-রূপক ব্যবহারে এবং কাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির মধ্যে কিছুটা অভিনবত্ব চোখে পড়ে। এটাই পাঠকের হৃদয়কে আকর্ষণ করে এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে তোলে। তিতাশ চৌধুরী উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের ব্যবহারে একধরনের স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টির মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কাব্যে রং ও কল্পনার বিন্যাসে অভিনবত্ব সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। সারা জীবন তিনি সংখ্যাতত্ত্ব ও হিসাব-নিকাশ নিয়ে ছাত্র জীবন ও পেশা জীবন অতিবাহিত করলেও এ সুন্দর পৃথিবীতে তাঁর যে একটি আলাদা কল্পনার জগৎ ছিল এবং সে জগতকে তিনি নিজের ইচ্ছামত রং ও রূপে অপরূপভাবে সাজিয়েছেন, তা তাঁর কাব্য পাঠ না করলে অবহিত হওয়া সম্ভব নয়। এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি-
অনেককাল থেকেই সংসার নদীর-নারীর কিনারে
জল প্রপাতের ভয়ঙ্কর শব্দ শুনে আসছি : কিছু কেনাকেটা
করতে গেলেই তপ্ত কড়াইয়ের মাছের মতো
চোখ উল্টে পায়, জ্বলে যায়।
(নদী ও নারী : কিছু যন্ত্রণা সুখ : দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী)
প্রতিদিনের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-ভালোবাসা, আশা ও আশাভঙ্গের বেদনার বাস্তব জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে প্রতিদিনের পরিচিত শব্দাবলীর বিন্যাসে। কিন্তু পরিচিত শব্দাবলী বিন্যাস-নৈপুণ্যে অভিনব হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি, উপমা-রূপক ও চিত্রকল্পের, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কুশলী ব্যবহারে তা অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় রূপ লাভ করেছে। এ অভিনবত্ব ও অসাধারণত্ব তাঁর প্রায় প্রতিটি কবিতায়ই পরিদৃষ্ট হয়। যেমন-
তোমার উজ্জ্বল শরীর থেকে ঝরে পড়ছে সোনালী বিকেল, পাখির নীড়
নীড়ের চোখ-ঝরে পড়ছে আগুন, পুরুষের হৃদপি-।
তুমি অবাক হয়ে দেখছো পৃথিবীর চাতুরালি বিশ্বাস
তোমার চারপাশে সোনাদানা জমে থাকে নিয়ত
তুমি হাসো যা খুশি কুড়িয়ে নাও, কেউ কেউ
নোঙ্গর ফেলে তোমার জল সীমানায়।
দীপ্ত অধিকারে।